সরষের ভেতরেই ভূত

PIN সরষের ভেতরেই ভূত

গতকাল অফিসে আসার পথে একটা মোটরসাইকেল এসে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির এক সাইডে এমন দাগ বসিয়ে দিলো, তা আর কী বলব। ড্রাইভারকে বললাম ওকে থামাতে। মোটরসাইকেল আরোহী থামলেন। লেখা ‘পুলিশ’,  নাম্বার প্লেটও নেই। কথায় এত বাজে আচরণ…। রাস্তায় জ্যাম লেগে যাওয়াতে সামনে থামতে বললাম। জ্যাম পার হয়ে তাকে আর পাওয়া গেল না। হায়রে ‘পুলিশ’! সেও পুলিশ, আর বাবুল আক্তারও পুলিশ (যদিও বড় অফিসার)। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের ছেলের রক্তেভেজা জুতাজোড়া ভেসে আসছে বারবার। কী ভয়াবহ অবস্থা! ছেলেটার মানসিক অবস্থার কথা অনুমান করে মনটা বারবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ার সামনে তাকে জিজ্ঞাসা করা, ক্যামেরার লাইট, এত মানুষ, প্রশ্ন, সবই কি সঠিক পথে এগুচ্ছে? এসব থেকে ছেলেটাকে একটু দূরে রাখতে পারছে না কেউ? রুচি এখন বিকৃত ও বুদ্ধি হাঁটুর নিচে।

সব অনলাইন, টিভি, পত্রিকা পড়ে বাবুল আকতার সম্পর্কে যা জানলাম, তা হলো তিনি জঙ্গিদের কাছে আতঙ্ক। চৌকস অফিসার, দেশের জন্য যেকোনও ত্যাগ করতে প্রস্তুত। মানে চট্টগ্রামের কুখ্যাতদের কাছে তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রশ্ন হলো, সবকিছুকে কেন বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখতে হবে বা দেখার একটা রেওয়াজ করা হবে? বিচ্ছিন্ন বলে কিছু নেই। কোনও না কোনও ঘটনার বা ষড়যন্ত্রের ফল এটা খুবই পরিষ্কার। যদিও মন্ত্রী এবার বলেছেন,  জঙ্গিরা করেছেন বা করতে পারেন। তার মানে কী দাঁড়ালো? দেশে জঙ্গি আছে? প্রত্যেক থানা-গ্রাম-মহল্লায় যদি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়, তাহলে জঙ্গিদের ধরা এবং তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানা সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের সব পুলিশ তো আর বাবুল আকতার নন। অনেকের আবার এলাকার উঠতি হাইব্রিডদের তোষামোদি করার পরে আর বাড়তি সময়ই পান না। এমপিদের কথায় উঠতে-বসতে সময় চলে যায়। অন্য কাজে সময় কই তাদের?

বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় থাকার ফলে, প্রশাসনের ভেতর থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় জঙ্গিদের এত বিস্তৃতি ঘটেছে যে, আমার মনে হয় না সরকারের একার পক্ষে তাদের দমন করা সম্ভব হবে। জঙ্গিবাদকে পুরোপুরি নির্মূল করতে চাই সম্মিলিত উদ্যোগ। এর আগে আমার এক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে জামায়াত আস্তে-আস্তে গ্রামে-গ্রামে মহিলাদের মাধ্যমে তাদের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। স্কুল কলেজে তাদের তৎপরতা আরও বেশি। এটা আমার নিজের চোখে দেখা।এই যে তাদের এত বিস্তৃতি, এটা কেন হয়েছে? এর দুটি কারণ—১) আমরা সচেতন নই। ২) নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। তারপর যেখানে সব মানবতাবিরোধীর বিচার যখন নিশ্চিত করছে বা সরকার যখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বিচার করবে, তখন থেকে শুধু পুলিশের ওপর নির্ভর না করে এমপি চেয়ারম্যান ছাত্রলীগ-যুবলীগ যার-যার এলাকায় টহল দেওয়া, খবর রাখা। কিন্তু তারা তো ব্যস্ত ভাইয়ের সঙ্গে সেলফি তুলতে।

শেখ হাসিনার সরকার যখন দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে, তখন শুরু হয়েছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। বাবুল আকতারের স্ত্রী হত্যা, শিক্ষক হত্যা, নাটোরের ব্যবসায়ী হত্যা অথবা অন্য ধর্মের মানুষকে আঘাত করা সবগুলোই একসূত্রে গাঁথা। কোনওটাই বিচ্ছিন্ন নয়। এই রকম ঘটনা ঘটলে বিশ্ব মোড়লরা চড়াও হবে। এতদিনে তো তারা কিছুই করতে পারেনি। কিন্তু তাদের চেষ্টা থেমে নেই। মোসাদ কাহিনি এর প্রমাণ। তাই আসুন আমরা নিজেদের আর কারও থেকে বিচ্ছিন্ন না রাখি। অন্তত স্বাধীনতার পক্ষের সরকারকে সমালোচনা না করে তথ্য দিয়ে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করি। শিক্ষক হিন্দু খ্রিস্টান পুলিশ, তারপর কি সাংবাদিক কিংবা মিডিয়া?

আমরা যুদ্ধ করেছিলাম স্বাধীনতার জন্য, মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য। আমরা চেয়েছিলাম একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। ঠিক যেভাবে স্বাধীনতার জন্য সব ধর্মের ও বর্ণের মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন, ঠিক সেভাবে আমরা দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু হায়! এ কি! হ্যাঁ, অসাম্প্রদায়িকতা আছে,  কিন্তু একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। এদেশে সব ধর্মের ও বর্ণের মানুষকে মোটামুটি একই রকমভাবে ও কারণে খুন করা হয়। হোক সে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম এবং তারপর খুন। ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ঘটলেও, এর পেছনের নিরবচ্ছিন্ন নীল নকশাটি কিন্তু আমাদের সবারই জানা। আর তা হলো দেশটিকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। যেটা যুদ্ধের সময়েও হয়েছিল। আর কারা করছে, সেটা আর বুঝতে বাকি নেই।

কিন্তু কথা হলো, কেন এগুলোর কোনও সমাধান হচ্ছে না? এগুলো বন্ধ করার কোনও উপায় কি নেই? কথায় আছে, ‘চেষ্টা থাকলে উপায় হয়’ । আমাদের মাঝে কি তাহলে চেষ্টার অভাব? কিন্তু আমি তো এর অবসান চাই, আপনিও চান। তাহলে অভাবটা কোথায়?

তাহলে কি ‘সরষে ক্ষেতেই ভূত আছে?’

আমাদের মাঝে হয়তো ভূত লুকিয়ে আছে। যারা আমার আপনার আড়ালে তাদের মদত দিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের বিবেকের কাছে পরাজিত হয়ে, অর্থের লোভে পরে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল দিয়ে যাচ্ছে। এই বিশ্বাসঘাতকতা কার সঙ্গে? এটা তো আজকে শুরু হয়নি। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত, লাখ-লাখ মানুষের রক্তের সিক্ত মাটিতে যখন মানবতাবিরোধীদের ডেকে এনে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, তখন আর বলতে বাকি থাকে না যে, সরষে ক্ষেতের ভূত কে বা কারা। আমাদেরই সামনে জামায়াত নামের রাজনৈতিক দলটি গড়ে উঠল আর আমরা কিছু বলিনি। ধর্মের খোলসে থেকে আমাদের ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে দেওয়ার বিরুদ্ধে সামাজিক-রাজনৈতিক এখনই রুখে না দাঁড়ালে ৭১-এর বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন হতে বেশি সময় লাগবে না।