সাবিরার মৃত্যু এবং মধ্যবিত্ত মানসিকতা

PIN

ফেসবুকের কল্যাণে গাড়িতে বা বাড়িতে যেখানেই থাকি না কেন, খুব সহজেই আজকাল জেনে নিতে পারি, কোথায় কী হচ্ছে, কীভাবে কী হচ্ছে । একই সঙ্গে যোগাযোগ, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, কমিকস্ সবকিছুর কাজ আজকাল ফেসবুকেই সেরে নেওয়া যায়।এছাড়া ইদানিং খুব জনপ্রিয় হলো- ‘ফেসবুকে ভিডিও’ আপলোড করা। মাঝে মাঝে কিছু কিছু মজার ভিডিও থাকে, যেগুলো দেখলে নিজে নিজেই হাসি। আজকালকার দিনে হাসিঠাট্টা, সুখ, দুঃখগুলোকে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মতো লোকের তো বড়ই অভাব। তবে সম্প্রতি একটি ভিডিও দেখে থমকে গেলাম। বিভিন্ন নিউজ ফিডের মাধ্যমে জানতে পেলাম, সাবিরা নামের একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ভার্চুয়াল জগতে সবাইকে জানিয়ে একটি মেয়ে আত্মহত্যা করলেন, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না। কারণ, আমরা তো ফেসবুক ফ্রেন্ড, রিয়েল লাইফের সঙ্গে আমাদের তো কোনও যোগাযোগ নেই। পুরনো দিনের বন্ধুদের মতো আমরা তার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে পারিনি, ‘তুই কী পাগলামি করছিস, আমরা আছিতো তোর পাশে’ । প্রযুক্তির পরাজয় এখানেই। কিন্তু এই সাবিরাকে আমরা বাঁচাতে না পারলেও কটাক্ষ করতে কিন্তু ছাড়িনি। তা মুখে যাই আসুক।কিন্তু মৃত্যু তো মৃত্যুই। আমাদের কোনও কথাই আর মেয়েটিকে ফিরিয়ে দেবে না। কিন্তু আমরা কী একবারও ভেবে দেখেছি যে, কতখানি দুঃখ পেলে একটি মানুষ এরকম বীভৎস একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? মানুষ কিন্তু নিজেকে নিজে অনেক ভালোবাসেন, সেটা তিনি যাই বলুক। সেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মানুষ কতখানি অপমানিত হলে নিতে বাধ্য হন? নাহ, আমরা এগুলো নিয়ে ভাবিনি। আমাদের এত সময় কোথায়? একটি মানুষকে পাগলের মতো ভালবাসার পরে যখন তিনি বুঝিয়ে দেন যে, ‘আমি তোমাকে শুধু ব্যবহার করেছি নিজের প্রয়োজনে’, তখন শুধু সাবিরার মতো মেয়ে না, আপনারও মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করবে।

হ্যাঁ, এখন অনেকেই বলবেন, এর চেয়ে কত মানুষ কত কষ্টে আছেন, কত মানুষ খেতে পান না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই মান অপমান বোধটা তো আপনাদেরই সৃষ্টি। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না. শুধুমাত্র মান-সম্মান হারাবার ভয়ে। সমাজে এই মান-সম্মান হারানোর জন্য কত সাবিরা যে তিলে তিলে মৃত্যুকে বরণ করেছেন তার খবর আমরা ক’জন রেখেছি। আমাদের সমাজের মেয়েরা যতই আধুনিক হোক, তার ভেতরের ‘মা’ বোধ কিন্তু সবসময়েই থাকে। শুধু সন্তান জন্ম দেওয়াই কি মাতৃত্ব? না। আপনার সম্পূর্ণ পরিবারকে একটি সুতোয় গেঁথে রাখাই হলো মাতৃত্ব। আপনার মা বাবা, ছেলে মেয়ে এমনকি আপনার নিজের সমস্ত দেখভাল করে যাচ্ছেন আপনার স্ত্রী। কেন করছেন? কারণ তিনি আপনাকে বিশ্বাস করেন, আপনাকে ভালোবাসেন। আপনি যত ভুলই করুন তিনি আপনাকে ক্ষমা করবেন। কারণ আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয়টাই যে খুব বেশি। আপনি একটা গ্রামে গিয়েই দেখুন না, অধিকাংশ মহিলারা তাদের স্বামীর হাতে নির্যাতিত হন। কিন্তু আপনি যদি তাকে তার স্বামীকে ছেড়ে দিতে বলেন, তিনি উল্টো এর প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু স্বামীকে নির্যাতনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, ‘যা করছি ভালা কাম করছি। এইসব মেয়েছেলে গো রে এইরাম শাস্তিই দেওন দরকার।’

সংসারে অশ্রদ্ধা, অপমান, অশান্তি লেগেই থাকে, তা সত্ত্বেও অনেক মেয়ে মুখ বুঝে সব সহ্য করেন। সংসারটাকে টিকিয়ে রাখেন। কিন্তু কেন? কারণ, অন্যরা কী বলবেন? মানুষ কী ভাববেন? এইভাবে অন্যায় অত্যাচার সব সহ্য করে অনেকেই একসময় আত্মহত্যা করেন। তাহলে শুধু সাবিরা নয়, আরও অনেকেই এই দলে আছেন। আবার অনিয়মিত জীবন-যাপন ও নিজের শারীরিক চাহিদার জন্য অনেকেই জীবন শেষ করে দেন। মেয়েরা দেহ মন উজাড় করে ভালোবাসেন। তিনি যাকে ভালবাসেন তাকে ঘিরেই তার স্বপ্নগুলো তৈরি হতে থাকে। কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারেন যে, শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছেন, তখন তিনি আসলে পড়েন মহাবিপদে। একদিকে যাকে তিনি মন প্রাণ দিয়ে ভাল বেসেছেন তার দ্বারা প্রতারিত হন। অন্যদিকে সমাজের কাছে ধিক্কার পেতে শুরু করেন। আর ঘুণে ধরার মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে একদিন মৃত্যুকে বেছে নেন। হায়রে পুরুষ! তুমি ভোগ করতেই শিখেছ, সম্মান দিতে শেখোনি!! তুমি কেমন পুরুষ??? নাহ, এটা একবার দুইবার না, যুগে যুগে কালে কালে একই অপমানের শিকার হচ্ছেন মেয়েরা। আমরা শিক্ষিত হচ্ছি, কিন্তু মানসিকতার কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। পুরুষশাসিত সমাজে সকলের মস্তিষ্কইতো একই চাবি দিয়ে ঘুরছে কী না!

নির্যাতনের কারণে স্বামীকে না হয় ছাড়লেন। কিন্তু কোথায় যাবেন? বাবা মার কাছে? কিন্তু কয়দিন? অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের তো প্রশ্নই আসে না। আর এই সময়ে কিছু কুকুরের মুখোশধারী শুভাকাঙ্ক্ষি পুরুষের অভাব নেই । একটা মেয়ে কোনওদিন গ্রামে একা থাকতে পারবেন? শহরে তো বাসাই ভাড়া নিতে পারবেন না। নানা লোকের নানান কথা। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে আপনাদের মধ্যে কেউ তার পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়ালে তিনি কিন্তু বেঁচে থাকাটাকেও বেছে নিতে সাহস পেতেন।

আসলে এইসব নীতিবাক্য লিখে শেষ করা যাবে না। আমি নিজে কতটুকু বিশ্বাস করছি, এটাই বড় কথা। এবার আসি সাবিরার কথায়। অনেকেই তার মৃত্যুকে “জুনকো ফুরুতা” এর মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করছেন। জুনকো মারা যান ১৯৮৯ সালে। কিন্তু ২০১৬ সালে এসে জীবনযাত্রার মান বদলালেও আমাদের মানসিকতা একটুও বদলায়নি। পৃথিবীতে মৃত্যুই হলো সব কিছুর শেষ পরিণতি। তাই এটা সকলের কাছে খুবই কষ্টের, তা সে যাই হোক। তাই হয়তো জুনকো ও সাবিরার মধ্যে অনেক পার্থক্য। একটা জীবন যদি বটগাছের মতো কাউকে সবসময় পাশে পায়, তিনি কি কোনওদিন এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাইবেন?

আরো পড়ুন
সরষের ভেতরেই ভূত