প্রজন্ম এবং আমাদের দায়বদ্ধতা

PIN প্রজন্ম এবং আমাদের দায়বদ্ধতা

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকা- হোলি আর্টিজান বেকারিতে এবং শোলাকিয়া ঈদ জামাতের সন্নিকটে জঙ্গি হামলার পর অনেক কিছুই সামনে চলে এসেছে, যা এতদিন সবার আলোচনার বাইরে ছিল। সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে জঙ্গি বা হামলাকারীদের ‘পরিচয়’। ইতোমধ্যেই প্রায় সব ক’জন জঙ্গির পরিচয় বের হয়ে এসেছে, যেখানে আমরা দেখেছি প্রতিটি জঙ্গিই উঠে এসেছে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সব পরিবার থেকে। এদের পরিচয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড়ও উঠেছে। আমরা এতটাই গণতান্ত্রিক যে, যার যা ইচ্ছা তাই বলছি, লিখছি। অনেকে আবার সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একেবারে তুলাধোনা করে ছাড়ছেন। কিন্তু একবারও ভাবছি না যে, শুধু দোষারোপ না করে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমেও আমরা সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করতে পারি। কিন্তু এ কাজটি করতে সবাই যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই অনিচ্ছুক!

আরও অবাক লাগছে কিছু শিক্ষিত রুচিশীল সমাজ, লেখক এবং নতুন প্রজন্মের ‘বিস্ময়’ প্রকাশ দেখে, কেন এত ভালো ঘরের ছেলেরা এমন হয়ে যাচ্ছে! তারা যেন বিশ্বাসই করতে চাচ্ছে না বড়লোক, সমাজের বড় বড় মানুষদের পরিবারে এমন ছেলেরা থাকতে পারে। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি আইএস যদি এই জঙ্গিদের ছবি তাদের সাইটে প্রকাশ না করত তাহলে কমান্ডো অভিযানের পর নিহত জঙ্গিদের লাশ দেখে সেই তথাকথিত রুচিশীল সমাজ এবং প্রজন্ম কোনোভাবেই বিশ্বাস করত না যে, এরা জঙ্গি। নিহত জঙ্গি নিরবাসকে নিয়ে প্রজন্মের ক্রাশ খাওয়ার উন্মাদনা এটাই প্রমাণ করে। এখানে আমার পর্যবেক্ষণ হলো, আমি মোটেও অবাক হইনি। মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা কম্প্রোমাইস করতে শিখে বড় হয়। নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের সন্তানদের পেটে খাবার না জুটলে হাল চাষ করে, ভ্যান চালায়, ধান কাটে, কামলা দেয়। আর যদি কিছুই না পারে তবে বাবা-মা তাদের মাদ্রাসায় দেয়। মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে জীবন পার করে। কিন্তু বড়লোকের ছেলেমেয়েরা কেন? কেন নর্থ সাউথ থেকে শুরু করে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়?

আমার কথা হলো কেন ভাই আমরা এভাবে চিন্তা করি, সব অপরাধ শুধু গরিব আর মধ্যবিত্তের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়? মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তদের অভাববোধ থেকেই যেন তৈরি হয় অপরাধ প্রবণতা! আর উচ্চবিত্তদের আমরা সব সময়ই একদম গোনার বাইরে রাখি, যেন তারা মুখে ভাত তুলে খেতে পারে না! আমাদের এমন চিন্তার খেসারত হিসেবে কিন্তু অনেকগুলো অঘটন ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। আসলে মানুষ তার যার যার অবস্থান থেকে খারাপ কাজে লিপ্ত। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে ড্রাগস নেওয়া। শুনতে খারাপ লাগলেও এই ড্রাগস ব্যাপারটি কিন্তু এই তথাকথিত হাইসোসাইটিতে কম নয়। মদ্যপান, সিসা বারে নিয়মিত আড্ডা, গাঁজা সেবন ইত্যাদি যেন এখন এই সোসাইটির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার! এখানে এই ছেলেমেয়েদের দোষ যেমন কম নয়, তেমনি বাবা-মায়েরও কম নয়। কারণ বাসায় একটি টেবিলে সবাই একসঙ্গে বসে ভাত খাওয়া এবং যার যার মতো বাইরে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার যার যার মতো কিনে খাওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমরা ভাবি যে, এসব পরিবারে হয়তো ম্যানার্স, সততা, শ্রদ্ধাবোধ, রুচিশীলতা, শিষ্টাচার শেখানো হয়। হ্যাঁ, হয়তো শেখেও তাই। কিন্তু বাবা-মায়ের অতিরিক্ত আত্মকেন্দ্রিকতা কথায় কথায় আমার গাড়ি, আমার সম্পত্তি, আমার ছেলে পড়বে এনএসইউতে, ব্র্যাকে অথবা বাইরে, আমার ছেলে অমুক হবে, এসব আমার আমার করতে করতে তাদের ছেলেমেয়েরা যে কখন আর তাদের থাকে না সেটা তারা টেরই পান না। আর যখন ছেলেমেয়েদের অপরাধ ধরা পড়ে তখন সমাজের ভয়ে সো কল্ড প্রেস্টিজের জন্য বলেন, ‘ও আমার সন্তান হতেই পারে না’ কী হাস্যকর কথা!

যে সমাজে বাস করছেন তা আমার-আপনার জন্যই তৈরি হয়েছে। তাই লোকচক্ষুর ভয়ে, সমালোচনার ভয়ে, মানুষ কী বলবে তার ভয়ে এসব বন্ধ করেন। কে কী ভাবল না ভাবল সেসব না ভেবে নিজের সন্তানকে, পরিবারকে, সমাজকে বাঁচান। এই দায়িত্ব আমার-আপনার সবার।