ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না

PIN ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবীরা একটা কথা প্রায়ই বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এসি রুমের দল নয়, কোনো ষড়যন্ত্র ও এলিটক্লাসের আড্ডাখানাও নয়, দলটির মূল শক্তি হলো এর বিশাল কর্মীবাহিনী।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও একটা কথা প্রায়ই বলতে শুনা যায় যে, তিনি যতবার বিপদে পড়েছেন তাঁর সাথে ছিলেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা। তাই তিনি এসব বিপদকে জয় করতে পেরেছেন। তিনি একথাও বলেন, অনেক বড় বড় নেতা বিপদে তাকে ছেড়ে গেলেও তৃণমূল সাথে থাকার কারণে সবসময়ই তিনি বিপদ মোকাবেলা করতে পেরেছেন।

একথাটি আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য ধ্রুব সত্য। বঙ্গবন্ধুও তেমন ছিলেন। বড় বড় রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে একমত হতেন না। কিন্তু তৃণমূলের কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকায় সবসময়ই বঙ্গবন্ধু জিতেছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। তৃনমূল কর্মী নির্ভর দল আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কি পরিস্থিতি তা জানা দরকার।

গত সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের উদ্দেশ্য করে একটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘এত বিভেদ থাকা যাবে না, ঘরের ভিতর মশারি তৈরি করা যাবে না।’ এর অর্থ হলো দলের মধ্যে কেউ বিদ্রহী প্রার্থী হতে পারবেন না।

ওবায়দুল কাদের যখন সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্যটি করেন তখন একজন কর্মীকে মন্তব্য করতে শোনা যায়, ‘ঘরের ভিতর মশারি না টাঙ্গালেও কয়েল তো জ্বালাতে হবে লিডার।’ এই কথাটি বলে বোঝানো হয়েছে দলের মধ্যে যে বিভেদ ও দ্বন্দ তা এতদিন মেটানোর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি, তাই মশারি না টাঙ্গালেও কয়েল জ্বালানো প্রয়োজন। কয়েলের ধোয়া কিন্তু বেশি ক্ষতিকর।

গত ১৪ নভেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাথে গণভবনে সাক্ষাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যে বক্তব্যটি রেখেছিলেন তা ছিলো হৃদয়স্পর্শী । তিনি সেদিন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কোন্দলের ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেন ও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদি আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চান তাহলে ঐক্যবদ্ধ হোন।’ একটা আসনে ৫০ জন প্রার্থী কেনো হবে এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতাশা প্রকাশ করেন। এসময় একজন কর্মী দূরে বসে মন্তব্য করেন, আপা আপনি ৩০০ আসনে প্রার্থী হোন আওয়ামী লীগ জিতবে। কিন্তু এমপিদের উপর বিশ্বাস করা যায় না। কর্মীদের এসব মন্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে গত ১০ বছরে দলের তৃণমূল পর্যায়ে এমপিদের বিরুদ্ধে কর্মীদের ক্ষোভের পরিমাণ।

একটি আসনে একই দলের অর্ধশতাধিক প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র তোলার অর্থ হলো এই এলাকার এমপি দলের সবাইকে নিয়ে চলতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে দলের বিরাট একটা অংশ দাঁড়িয়েছে। তিনি তার সংসদীয় আসনের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখেননি। এলাকায় তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য দলের বিরাট অংশ মুখিয়ে ছিলো। মনোনয়ন পত্র সংগ্রহের সময়ই তারা সেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন।

আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করলে দেখা যায়, নির্বাচনের আর মাত্র দেড়মাস বাকি। মনোনয়ন পত্র সংগ্রহের সময় আওয়ামী লীগের পুরো কেন্দ্রীয় কমিটিই ঢাকায় অবস্থান করছেন। তারা প্রতিদিন পার্টি অফিসে যাচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে এখন পার্টি অফিসে প্রতিদিন যাওয়ার কি প্রয়োজন সেটা বোধগম্য নয়। মনোনয়ন পত্র বিক্রি করার জন্য দপ্তরের দায়িত্বে একাধিক নেতা রয়েছেন, এর আওতাধীন উপকমিটি রয়েছে। কেনো আওয়ামী লীগের নেতারা এলাকায় এলাকায় যাচ্ছেন না সেই প্রশ্ন নেতাকর্মীদের মনে উদয় হয়েছে। ঠিক এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় কমিটি যাননি। গেলেও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখেননি, তৃণমূল নেতাকর্মীরাও তাদের কাছে ঘেষতে পারেননি।

অনেক কেন্দ্রীয় নেতাই ঢাকায় বসে স্থানীয় রাজনীতির অবস্থা সম্পর্কে ধারনা করে ফেলেন। এতে যে সমস্যা হয় তা হলো, ঢাকায় যেসব টাকাওয়ালা নেতারা আসতে পারেন ও নেতাদের সাথে দেখা করতে পারেন তারা যেভাবে বলছেন সেভাবেই কেন্দ্রীয় নেতারা এলাকার খবর জানছেন। কিন্তু যে কর্মীরা ঢাকায় আসতে পারেন না, নেতার সাথে সহজে দেখা করতে পারেন না তার কথাটি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা জানছেন না। তাই কেন্দ্রীয় নেতারা স্থানীয় রাজনীতির একপেশে খবর জানছেন। প্রকৃত অবস্থা না জানার কারনে সেসব এলাকা নিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও প্রায়ই তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনমত হয় না। এছাড়া সারা বছর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থেকে ভোটের সময় গিয়ে পরামর্শ, উপদেশ দিলে সেই কর্মীদের মনে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে না।

গত ১০ বছরে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নই এই দলটির আগামী নির্বাচনে প্রধান শক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বও নৌকার পক্ষে ভোটের আরেকটি মূল কারণ হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা ও বেশিরভাগ এমপিরা দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ না রাখার ব্যর্থতর ফলও ভোগ করার আশংকা আছে।

একটা কথা বলা হয়, সারাবছর বিরোধীশক্তির বিপক্ষে আন্দলন সংগ্রামের কোনো মানেই থাকবে না যদি নির্বাচনের সময় বিদ্রোহ ঠেকানো না যায়। এবারের নির্বাচনে প্রতিটি আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের যত নেতা মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করেছেন তা থেকে বিদ্রোহ বা অসহযোগিতার আশংকা প্রবল। এসব সমস্যা দূর করার সময় যদিও অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে তবুও এখনই উদ্যোগ নিতে হবে আওয়ামী লীগকে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের এটা বুঝতে হবে এত বিদ্রোহী প্রার্থী কেনো তৈরি হচ্ছে আওয়ামী লীগে? যারা এমপিদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন তারা সবাই কি সুসময়ের কোকিল? এভাবে সরলীকরণ করে দলের নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে না দিয়ে তাদের কথাও শুনতে হবে। গত ১০ বছর কি জন্য তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করছেন তা শুনতে হবে।

আমাদের সকলেই এ বিষয়ে একমত যে আওয়ামী লীগ ছাড়া এদেশ পরিচালনা করার মত কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের হাতেই দেশ নিরাপদ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই দেশ এগিয়ে যায়। দলের সকল কর্মীই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে হলে সবাইকেই বুঝতে হবে ঐক্যের গুরুত্ব। রাগ, ক্ষোভ, অভিমান থাকবেই, তবে বৃহত্তর স্বার্থে প্রত্যেককেই ছাড় দিতে হবে। কেন্দ্রীয় নেতাদের তৃণমূল নেতাকর্মীদের রাগ, অভিমানের কথা শুনতে হবে ও ভবষ্যতে যাতে তারা বঞ্চিত না হয় সেই প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে। কেন্দ্রীয় নেতাদের এটা বুঝতে হবে শেখ হাসিনার প্রত্যেক কর্মীই সমান গুরুত্বপুর্ন। তৃণমূল ছাড়া আওয়ামী লীগের গতি নেই। আওয়ামী লীগ তৃনমূল নির্ভর দল। তাই শেখ হাসিনাকে জিতিয়ে আনতে হলে তৃণমূল শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।